নিজস্ব প্রতিবেদক
বিএনপির অন্যতম নীতিনির্ধারক ড. মঈন খান বলেছেন, ‘সংস্কার ও নির্বাচনকে পাশাপাশি নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে অন্তবর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কাঠামো পরিবর্তন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আজকে সরকার যৌক্তিক সময় দাবি করছে। যৌক্তিক সময় নির্ধারণ করা কঠিন।’
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকালে গুলশানের একটি হোটেলে ‘গণতন্ত্র উত্তরণে অন্তর্বতীকালীন সরকার তথা রাজনৈতিক দলের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। বৈঠকের আয়োজন করে মিলিনিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় ও খান ফাউন্ডেশন।
বৈঠকে অত্যাবশকীয় সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে পাশাপাশি রাখার দাবি জানিয়েছে রাজনৈতিক, শিক্ষার্থী ও সুশীল সমাজ। পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
দেশের নানা সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব বর্তমান সরকারের হলেও মানুষ জবাব চায় বিএনপির কাছে উল্লেখ করে মঈন খান বলেন, ‘মানুষ মনে করছে বিএনপি সরকারে চলে এসেছে। মানুষের এই পারসেপশনের (ধারণা) বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘এই সরকারকে ম্যান্ডেড দিয়েছে ছাত্র-জনতা। আজকে ৫৩ বছর পরে ছাত্র-জনতা যা করছে তা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। যা কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারেনি। এর কারণও যৌক্তিক- কারণ আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বিদায় দিতে চেয়েছিলাম। আমরা ১৭টি জীবন দিয়েছি আর ছাত্ররা ১৭ দিনে ১৭শ জীবন দিয়েছে। এ কারণেই তারা সফল হতে পেরেছে। ছাত্র জনতা যা পেরেছে তা রাজনৈতিক দল করতে পারেনি, কারণ ছাত্রদের কোনো পিছুটান ছিল না।’
বৈঠকে বিএনপির যুগ্ন মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় জনগণই দেবে, অন্য কেউ নয়। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটা সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন করা।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের উচিৎ এই মুহূর্তে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা। কারণ কেনো পাইপলাইন ছাড়া যে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে দেশ চালানো অসম্ভব।’
বিএনপির এ নেতা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘একটি কুচক্রী মহল ছাত্রদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র করছে; এটা হতে দেওয়া যাবেনা। এসব ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ছাত্র-জনতার জয় পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এখন পুরোপুরি গণতন্ত্র ফেরাতে সংস্কার জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘দেশে একটা নির্বাচন ভালোভাবে করতে হলে প্রশাসনকে সাজিয়ে জনবান্ধব পুলিশ গড়ে তুলতে হবে। পুলিশ, সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন সব রিসাইকেল করে নতুন করে সাজাতে হবে।’
মান্না বলেন, ‘একটি উপযোগী ভোট করতে কতোটা সময় লাগতে পারে সে হিসাব করেই অন্তবর্তীকালীন সরকারকে সময় নিতে হবে। কোথায় কোথায় অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাজ করতে হবে, তা খুঁজে বের করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশ সংস্কারের কাজে এগিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনের টাইমফ্রেম বেঁধে দেওয়া এই মূহূর্তে ঠিক হবে না। ড. ইউনূসেরও উচিৎ হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই দেশ সংস্কারের কাজ করা।’ ড. ইউনূসের সরকারে কোনো রাজনৈতিক দলের কেউ না থাকার কারণে নতুন সংকট সৃষ্টি হওয়ারও আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
গণফোরামের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের পতনের পরে আমরা এখন স্বস্তির মধ্যে আছি। তবে অনেক পাপিষ্ঠ আমাদের আশেপাশে ঘুরছে। মাঠে ময়দানে জাতীয় পার্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলন বিবৃতি দিয়ে সমর্থন দিয়েছিল, মাঠে নামেনি। তারা পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গে মিলে নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছিল। এখন এসব শত্রুদের পরিত্যাগ করতে হবে। আন্দোলনে সকল শহীদের পরিবারকে খুঁজে বের করে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে।’ তিনি বলেন, ‘এই সরকারকে চাপাচাপি করা যাবে না, তাদের সংস্কারের সময় দিয়ে কাজে সহায়তা করতে হবে।’
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরু বলেন, ‘এই আন্দোলন ২০০৮ সালে আমরাই নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। এখনকার মতো ভুক্তভোগীদের সহায়তা করতে পারিনি- এটা অত্যন্ত কষ্টের।’ তিনি বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে এ আন্দোলনে সব শ্রেণিপেশার মানুষের সম্পৃক্ততা সমান। গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াতের মতো মেজর রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত আন্দোলনের ফল হাসিনা সরকারের বিদায়।’
নুর বলেন, ‘এখনও চক্রান্ত চলছে। এই সরকার পুলিশ প্রশাসনকে এখনও নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি, এটা অত্যন্ত জরুরি। প্রসাশনকে মাস্ট বি ক্লিন করতে হবে। বিচার বিভাগ এখনও নিরপেক্ষ নয়, যেখানে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। নতুন নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন দরকার।’
তিনি বলেন, ‘একটি অনির্বাচিত সরকার বেশিদিন থাকলে; সেখানে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট হবে না। এ জন্য নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ সামনে রেখে সংস্কার কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া ছাড়া সংকটের সমাধান হবে না।’
দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ নতুন করে স্বাধীন হওয়ার পরে এখন পরিবর্তন কিভাবে তবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। তবে পরিবর্তন কারো মধ্যেই তেমন হয়নি। ক্ষমতার অপব্যাবহার কমাতে হবে, অতীতের স্বৈরাচার শাসকের পতন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন খোলসে আত্মপ্রকাশ করতে হবে, যদি তারা গণতন্ত্রকে আবার দেশে ফিরিয়ে আনতে চায়।’
তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপিকে সবচেয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে সব পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা দায়বদ্ধ থাকবেন নাগরিকের কাছে। আগামী নির্বাচনে যাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে তাদের হলফনামা পরীক্ষা করে মনোনয়ন নিশ্চিত করুন। বিএনপির জন্য এবারের নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হবে অত্যন্ত কঠিন। তাই তাদের ধৈর্য্য ধরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তারা সহায়তা করুক। কারণ এই সরকার ব্যর্থ হলে বিপ্লবের সকল অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তবে এই মুহূর্তেই একটা নির্বাচনকালীন রোডম্যাপ সামনে এনে সংবিধান সংশোধন জরুরি।’
দি মিলিনিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারপার্সন, বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের অ্যাডভোকেট রোখসানা খন্দকারের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন- আইন ও সালিশ কেন্দ্রর সাবেক মহাসচিব নূর খান লিটন, সাংবাদিক আাশরাফ কায়সার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেমার সাবেক সভাপতি মুনিরা খান, মায়ের ডাকের সমন্বক সানজিা ইসলাম তুলি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে সহসভাপতি তানিয়া রব, ড. সায়ন্ত সাখাওয়াতসহ অনেকে।