নিজস্ব প্রতিবেদক
নরসিংদীর শেখেরচরের একটি মহিলা মাদ্রাসায় চারতলার শৌচাগার থেকে আফরিন আক্তার (১৬) নামে এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ওই সময় মাদ্রাসায় পাঠদান চলছিল। উদ্ধারের পর বুধবার (১৯ অক্টোবর) দুপুর দেড়টার দিকে ওই ছাত্রীর লাশ নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে বিষয়টি জানাজানি হয়। এর আগে জামিয়া কওমিয়া মহিলা মাদ্রাসা নামের পাঁচতলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির চারতলার শৌচাগার থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
আফরিন আক্তার নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী থানাধীন দড়িগাজীরগাঁও এলাকার ডালিম মিয়ার মেয়ে ও ওই মহিলা মাদ্রাসাটির ফাজিল প্রথম বর্ষের (উচ্চমাধ্যমিক সমতুল্য) শিক্ষার্থী।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানায়, সকাল ৮টার আগে আফরিন আক্তারকে মাদ্রাসায় নিয়ে আসেন তাঁর বাবা ডালিম মিয়া। ওই সময় আফরিন মাদ্রাসার গেইট দিয়ে ঢুকতে চাচ্ছিল না, তাকে জোর করে মাদ্রাসার ভেতরে ঠেলে দিতে দেখা যায় ডালিম মিয়াকে। এ সময় আফরিন বলছিল, আমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করব না, বেশি জোর করলে ফাঁস লাগিয়ে মারা যাব। তখন তাঁর বাবা বলছিল, মরলে মাদ্রাসার ভেতরেই মর, আমি এসে লাশ নিয়ে যাব।
মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, জোর করে মাদ্রাসায় দিয়ে যাওয়ার পর যথারীতি ক্লাস করছিল আফরিন। পরে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শ্রেণিশিক্ষকের কাছে অনুমতি নিয়ে চারতলার একটি শৌচাগারে যায় সে। এরপর আর ওই ক্লাসে ফেরেনি আফরিন। পরে বেলা ১টার দিকে কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই শৌচাগারে গেলে আফরিনকে দেয়ালের ভেন্টিলেটরে নিজের ওরনায় ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। তাদের চিৎকারে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক রোজী সরকার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মাদ্রাসা শিক্ষক মো. আহসানুল্লাহ জানান, পারিবারিক কারণেই ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। আমাদের গেইটসংলগ্ন সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা যাচ্ছে, মেয়েকে জোর করে মাদ্রাসায় দিয়ে গিয়েছিলেন বাবা। কি কারণে ওই ছাত্রী মাদ্রাসায় আসতে চাইছিল না, এটি খুঁজে বের করতে পারলেই আত্মহত্যার কারণ জানা যাবে। এই ঘটনায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কোন গাফিলতি নেই।
মাদ্রাসাটির গেইটম্যান ইদ্রিস আলী জানান, বাড়ি থেকে নির্যাতন করে ওই ছাত্রীকে মাদ্রাসায় নিয়ে এসেছিলেন বাবা। আমার সামনেই ডালিম মিয়া তার মেয়েকে বলেন, মরলে এখানেই মর, আমি এসে লাশ নিয়ে যাব। এর আগেও অনেকবার জোর করে মেয়েকে এখানে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
নরসিংদী সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বাবা ডালিম মিয়া মেয়ের লাশ একা ফেলে তড়িঘড়ি ছুটছেন জেলা প্রশাসনে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ হস্তান্তরের আবেদন করতে। এ সময় ডালিম মিয়া বলেন, আমার মেয়ে বেশ কিছুদিন ধরে ওই মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছিল না। আজ সকালে সে বলছিল, মাদ্রাসায় পাঠালে কিছু খাবে না। আমি বলেছিলাম, না খেলে না খাবি, মাদ্রাসায় যেতেই হবে। পরে আমি একপ্রকার জোর করে ওই মাদ্রাসায় দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এই সামান্য কারণে মেয়ে আমার অত্মহত্যা করে বসবে, ভাবতে পারছি না। পরে দুপুরে শিক্ষকদের কাছে খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে তার লাশ দেখতে পেয়েছি।
‘মরলে মাদ্রাসার ভেতরেই মর, আমি এসে লাশ নিয়ে যাব’ তার এই কথার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এই ধরণের কোন কথা মেয়েকে বলেননি বলে জানান।
নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক রোজী সরকার জানান, আফরিন নামের ওই ছাত্রীকে আমরা মৃত অবস্থায় পেয়েছি। তাঁর গলায় ফাঁস নেওয়ার মত চিহ্ন আছে। তবে এটি আত্মহত্যা নাকি হত্যাকাণ্ড, এখনই বলা যাচ্ছে না। কিভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর বলা যাবে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. আল আমিন জানান, প্রাথমিকভাবে বিষয়টি আত্মহত্যা বলে জেনেছি। শুনেছি ওই ছাত্রীর বাবা জেলা প্রশাসনের কাছে কোন অভিযোগ নেই মর্মে বিনা ময়নাতদন্তে লাশ হস্তান্তরের আবেদন করেছেন। ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল)কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদি প্রয়োজন মনে হয় তবে অবশ্যই লাশের ময়নাতদন্ত হবে। এছাড়া যেকোন অপমৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় এমনিতেই মামলা হয়ে থাকে।
ময়নাতদন্তের বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ এস এম ইবনুল হাসান বলেন, সাধারণত সড়ক দুর্ঘটনার মত বিষয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট থানা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সুপারিশ সাপেক্ষে আমরা বিনা ময়নাতদন্তে লাশ হস্তান্তরের অনুমতি দিয়ে থাকি। তবে আত্মহত্যার মত বিষয়গুলোতে এই ধরণের অনুমতি দেওয়ার সুযোগ নেই। অনেক ধরণের বিষয়ই এর মধ্যে থাকতে পারে, তাই তদন্তের স্বার্থে ময়নাতদন্ত হওয়া দরকার।