নিজস্ব প্রতিবেদক
রংপুরে দুই দিনের বৃষ্টিতে বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে বৃষ্টির পানি জমে আলুর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। আর কয়েকদিন পরেই জমি থেকে আলু তোলার ধুম পড়বে। কিন্তু মাঘের শেষের এই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে বেশির ভাগ আলুর জমি পানির নিচে।
শীতের বিদায়ক্ষণে আবহাওয়ার এমন ছন্দপতনে শঙ্কিত রংপুরের আলু চাষিরা। বৃষ্টি বেশি হলে জমিতে পানি জমে আলু নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় এখন আলু তোলার ধুম পড়েছে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই মিলে মাঠ থেকে আলু তুলছে।
আলু চাষীরা বলছেন, এই অবস্থা আরও ২-৩ দিন স্থায়ী হলে আলু ছাড়াও সরিষা, গম, সবজিসহ অন্যান্য ফসলও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শনিবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্কুরণী ও মমিনপুরের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে এমনটি জানা গেছে।
এই অবস্থায় শুধু রংপুর সদরই নয়, জেলার মিঠাপুকুর, পীরগাছা, কাউনিয়া, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাতেও। বৃষ্টি বিড়ম্বনায় আলু নিয়ে চিন্তায় আছেন রংপুর সিটি করপোরেশনের আলু চাষিরাও।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (০৩ ফেব্রুয়ারি) রাত থেকে শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় জেলার বেশির ভাগ আলুর জমিতে পানি জমেছে। কৃষকরা কিছু কিছু জমি থেকে আগাম জাতের আলু তুললেও বেশির ভাগই এখনও উঠানো হয়নি। জমিতে পানি জমে থাকায় তারা হতাশায় ভুগছেন। এখন কোথাও কোথাও জমি থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও আলু তোলা হচ্ছে।
পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর গ্রামের কৃষক নুর হোসেন জানান, শুক্রবারের বৃষ্টির পর শনিবার সকাল থেকেই জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি প্রায় ৫৬ শতাংশ জমিতে আলু চাষ করেছেন। দুই দিনের বৃষ্টিতে আলুগাছ পানিতে তলিয়ে গেছে। জমে থাকা পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পুনরায় বৃষ্টি হলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। যদি রোববার অথবা সোমবার থেকে টানা রোদ ওঠে তাহলে আলু কিছুটা রক্ষা পেতে পারে।
রংপুর নগরীর সাহেবগঞ্জ এলাকার আলু চাষি শামছুল হক ১০ একর জমিতে এবার আলুর আবাদ করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টি শুরু হলে শুক্রবার সকাল থেকে আলুখেতের নালা দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দুপুর থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হওয়াতে তিনি এখন ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
এই আলু চাষি বলেন, ইতোমধ্যে আমার বেশ কিছু জমির আলু তোলা শুরু হয়েছে। আবহাওয়া ভালো না হলে দু-একদিনের মধ্যে সব আলু তুলতে হবে।
মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ী সেড়ুডাঙ্গা এলাকার আবু বকর সিদ্দিক নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘মাঘের বৃষ্টি হামাক শ্যাষ করচে বাহে। জমির রোপন করা সোগ ধান বৃষ্টির পানির তলে গেইছে। আলু আর সরিষার খ্যাতেরও একই অবস্থা। আলুর জমিতে পানি জমি থাকলে তো পচন ধরবে। এমনিতে এবার আলুর দাম না, তার ওপর বৃষ্টিতে হামরা শ্যাষ। এমন হইলে কেমন করি আলুর আবাদ করমো। এবার লস (লোকসান) হইবে, আর আলু চাষ করমো না।’
পীরগাছার তাম্বুলপুর এলাকার কৃষক আলামিন মিয়া বলেন, এ বছর আলুর ফলন বাম্পার হলেও বাজারে তেমন দাম নেই। আগাম আলু সংরক্ষণ ও বাইরে রপ্তানির কোনো সুযোগ না থাকায় আমরা দাম পাচ্ছি না। তার ওপর দুই দিনের বৃষ্টিতে আলু নিয়ে তো আরও সমস্যা বেড়ে গেল। আর্থিকভাবে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চাষাবাদ ছেড়ে দিতে হবে।
রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্কুরণী ইউনিয়নের পালিচড়া গ্রামের আলু চাষি মিজানুর বলেন, আমার ৫ বিঘা জমির আলুগাছ পানিতে তলিয়ে গেছে। এবার ধারদেনা করে আলুর আবাদ করেছি। এখন যে অবস্থা তাতে অর্ধেক টাকার আলু বিক্রি করতে পারব কিনা সন্দেহ।
মিজানুরের মতো অন্য চাষিরাও আলুর পাশাপাশি সরিষা, গম ও সবজি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
শীতময় মাঘ মাসে হঠাৎ এমন বৈরী আবহাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি জমে থাকা খেত থেকে কোমর বেঁধে আলু তুলতে নেমে পড়েছেন কৃষকরা। এবার আলুর ফলন বাম্পার হলেও বাজার দর আর হঠাৎ বৃষ্টির প্রভাবে কৃষকের মুখে হাসি নেই। মৌসুমরে শুরুতে আগাম জাতের আলু প্রতি বস্তা (৯০ কেজি) দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি করা হলেও গত দুই সপ্তাহ থেকে বাজারে ধস নেমেছে।
বর্তমান বাজারে প্রতি বস্তা ইস্ট্রিক, ডায়মন্ড, কার্ডনাল জাতের আলু ৫শ টাকা থেকে ৬শ টাকা এবং গ্রানুলা জাতের আলু ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। যা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি কেজি দরে ৫ থেকে ৭ টাকা করে। কিন্তু এসব আলুতে উৎপাদন খরচ হয়েছে কেজি প্রতি ১০ থেকে ১১ টাকা করে। গত দুদিনের বৃষ্টির পর কেজিতে কৃষকের উৎপাদন খরচ অনুযায়ী ৪ থেকে ৫ টাকা করে লোকসান হবে বলে মনে করছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ভারী বৃষ্টি হলে বা দু-একদিন আবহাওয়ার পরিবর্তন না হলে মাঠে থাকা আলুর ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে নিচু জমির আলু চাষিরা বিপাকে পড়বেন। আলু যেহেতু পচনশীল, তাই যত দ্রুত সম্ভব জমি থেকে পানি নিষ্কাশন করতে হবে। না হলে ক্ষতির মুখে পড়বেন কৃষকরা। তবে অকাল বৃষ্টিতে কী পরিমাণ আলুর ক্ষতি হয়েছে, তার হিসেব নেই কৃষি বিভাগে।
এব্যাপার রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মাহবুবার রহমান বলেন, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই অঞ্চলে ৯৭ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন করা হয়েছে। এ বছরও একই পরিমাণ জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় ৫১ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর আগাম জাতের আলু রয়েছে। এসব আলু উত্তোলন করে কৃষকরা অন্য ফসল রোপণের জন্য জমি প্রস্তুত করতে শুরু করেছেন।
এদিকে রংপুর অঞ্চলে আলু সংরক্ষণে ৬৭টি হিমাগার রয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি হিমাগার রয়েছে রংপুরে এবং ১০টি নীলফামারী জেলার মধ্যে। বাকি তিন জেলায় ১৭টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারে আলু সংরক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক চাষিই বাড়িতে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জেলায় ৫৫ দশমিক ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। শনিবারের পর রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির প্রভাব কমে আসবে। বৃষ্টির ফলে দিনের তাপমাত্রা আরও একটু কমে আসবে বলেও তিনি জানান।