ড. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন
ভাষা মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। ভাষা শুধু যে মনের ভাব প্রকাশের বাহন তা নয়, ভাষা একটি দেশের শিক্ষা, সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, গণতন্ত্রেরও বাহন। ভাষার মাধ্যমে প্রত্যেকটি জাতির উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটে থাকে অর্থাৎ ভাষা জাতির অস্তিত্বের সাথে জড়িত। তাই ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। পৃথিবীর নানা ভাষার মধ্যে বাংলা হলো অন্যতম প্রধান ভাষা। এই ভাষা জন্মের পর থেকে দীর্ঘ কন্টাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে এসেছে। পাকিস্তান সৃষ্টির বহু পূর্ব থেকে সেই সুপ্রাচীন কালে থেকেই লেখক ও চিন্তাবদরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়টি তুলে ধরেন সংবাদপত্র ও পুস্তক পুস্তিকায় পাতায়। বাংলা ভাষার উপর সর্বশেষ আঘাত আসে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সাথে সাথে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর শাসকচক্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শরু করে। পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠে। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আেেন্দালন মানেই আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষায় আন্দোলন। এই উপলদ্ধি থেকেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।
ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। আমাদের মহান স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। এই মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতি বিজড়িত ২১ ফেব্রæয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙ্গালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে অন্যতম ও শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও অমর একুশে আজ আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।
১৯৪৭ সালে ভাষা-আন্দোলনের সূচনা পূর্ব থেকেই নরসিংদীতে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরুর পেছনে নরসিংদীর কৃতি সন্তানদের ভ‚মিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল। পাকিস্তান সৃষ্টির পর শাসকচক্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে সর্বত্র উর্দু ভাষা চালুর ষড়যন্ত্র শরু করে। নবগঠিত রাষ্ট্রের পরিচালনা, কাঠামো ও ভাষারসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনার জন্য মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মী, বৃুদ্ধিজীবী, ছাত্রনেতা, সাংবাদিক ও অধ্যাপকের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় নরসিংদীর বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও রাজনীতবিদ রাজীউদ্দিন ভুইয়ার (উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম মহিলা চিকিৎসক ও ভাষাসৈনিক অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর স্বামী) দোতলা বাড়ির বিরাট হল রুমে। এটা ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকার প্রথম সাংস্কৃতিক বৈঠক। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সাথে ভাষার প্রশ্নটিও আলোচিত হয়। উক্ত বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নরসিংদীর কৃতি সন্তান, রাজী উদ্দিন ভুইয়া ও ডা. জোহরা কাজীর ভূমিকা ছিল অনবদ্য। এর অল্প কিছুদিন পর ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ তারিখে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তৎকালীন শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে ঢাকার ১৯ নং আজিমপুরে গঠিত হয় ভাষা-আন্দোলনের সূচনাকারী সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’।
তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এই সময় নরসিংদীতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়। তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এডভোকেট ফজলুর রহমান ভুইয়া নরসিংদীতে ভাষা-আন্দোলন সংগঠনে বিশেষ অবদান রাখেন। জনাব ফজলুর রহমানের জন্মস্থান নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার অন্তর্গত লেবুতলা ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রাম। ভাষা-আন্দোলনের সেই সূচনা পর্ব থেকেই তিনি ভাষা-আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য তাঁর নিজ এলাকা নরসিংদীতে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তারই উদ্যোগে তখন নরসিংদীর বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং তমদ্দুন মজলিসের শাখা গঠিত হয়। ভাষা-আন্দোলনের সূচনাকারী সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামটিও তার দেওয়া। তিনি মনোহরদী, হাতিরদিয়া এবং নরসিংদীর অন্যান্য অঞ্চলে এ সময় তার সমমনা লোকদেরকে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৪৭ সলে ভাষা-আন্দোলনের সেই সূচনা পর্বে বাংলাকে যখন অনেকেই পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে দ্বিধান্তি ছিলেন, তখন থেকেই বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টায় তিনি নরসিংদী এবং ঢাকায় ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালন করেন। নরসিংদী মনোহরদীর আরেক কৃতি সন্তান আজকের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মরমি ও মানবতার কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী ছিলেন ১৯৪৭-৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনের সাহসী সৈনিক। তার জন্মস্থান মনোহরদী উপজেলার (বর্তমানে বেলাব) হাড়িসাঙ্গান গ্রামে। সাবির আহমদের সহযোগী হিসেবে এ সময় ঢাকা এবং মনোহরদী তথা নরসিংদীতে ভাষা-আন্দোলনে আরও যারা অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছিলেন তারা হলেন-মহসিন ভুইয়া (চুলা, মনোহরদী), মোশারফ ও ইসমাইল (নরসিংদী)।
১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনে নরসিংদীতে ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা শহরে এবং পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। এটি ছিল পাকিস্তান উত্তর প্রথম হরতার কর্মসূচি। এদিনে নরসিংদীতে পরিপূর্ণভাবে হরতাল কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ভাষা-আন্দোলন ভালোভাবে রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করার পূর্ব পর্যন্ত উপদলীয় নেতারা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও অন্যান্য কর্মীদের সাথে যোগাযোগের জন্য মাঝে মাঝে সফর করতেন। সেই উদ্দেশ্যে নরসিংদীতে একটি কৃষক সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় মুহম্মদ আলীর সভাপতিত্ব এবং ড. মালেক, তফাজ্জল আলী, কামরুদ্দীন আহমদ প্রমুখ কয়েকজনের বক্তৃতা দানের কথা ছিল। নির্ধারিত দিনে সকাল দশটার সময় অর্থাৎ ট্রেন ছাড়ার কিছু পূর্বে মুহম্মদ আলী নরসিংদী না যাবার সিদ্ধান্ত জানিয়ে কামরুদ্দীন আহমদকে খবর দেন। এর কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, জিন্নাহর কাছে এই মর্মে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তাঁর জমিদারী কর্মসূচিকে রাষ্ট্রদ্রোহী বিবেচনা করায় তার পক্ষে কৃষক সভাটিতে যাওয়া আর সম্ভব নয়। তফাজ্জল আলী বলেন যে, মুহম্মদ আলীর সিদ্ধান্ত জানার পরও তিনি নরসিংদী যাবার কর্মসূচি পরিবর্তন না করে পূর্ব কথামতো সেখানে যান এবং যথারীতি বক্তৃতা করেন।
১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ব্যাপক গতি লাভ করে এবং ভাষা-আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। নরসিংদীতেও এ আন্দোলনের তীব্রতা প্রকাশ পায়। এ সময় একপর্যায়ে নরসিংদী সফরে আসেন মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, তৎকালীন এমএলএ আনোয়ারা বেগম। তারা এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। এ সভায় প্রচুর লোকের সমাবেশ ঘটে। বাংলাভাষাসহ পাকিস্তানের বৈষম্য এবং মুসলিম লীগ সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতি নরসিংদীবাসী সচেতন হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সাল থেকেই নরসিংদীর মোসলেম উদ্দিন ভুইয়া ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তার বন্ধু সাদত আলী শিকদার তখন ঢাকা মেডিকেল হলের ভিপি। তার উৎসাহেই মোসলেম উদ্দিন ভ‚ঁইয়া বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের মিটিং মিছিলে অংশ নেন।
১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে নরসিংদীর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। নরসিংদী ছাত্র-যুবকদের উদ্যোগে আন্দোলন গড়ে ওঠে। মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা ছাত্র-যুবকরাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক নরসিংদীতে সাংগঠনিক সফরে আসেন। ঢাকার আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য স্থানীয় যুবক-ছাত্ররা তাকে চাঁদা তুলে দেয়। তাঁর সফরের পর নরসিংদীতে ছাত্র-যুবকদের মধ্যে ভাষার প্রশ্নে সচেতনতা দেখা দেয়। মিটিং-মিছিল ও সভা সমাবেশের কর্মসূচি নেওয়া হয়।
নরসিংদীর ঐতিহাসিক উয়ারী বটেশ্বর এর প্রত্মতাত্তিক নিদর্শন সংগ্রাহক ও গবেষণার পথিকৃৎ মোহাম্মদ হানীফ পাঠান ১৯৪৮ সাল থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৯৫১ সালে জমিয়তে ওলামায়ে এছলাম কতৃর্ক বাংলাভাষা বিরোধী ‘উর্দূর পক্ষে পঞ্চাশ পয়েন্ট’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ হানীফ পাঠান এর প্রতিবাদে নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তিনি রায়পুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করেন। এ সময় তিনি সামছুল হক মোল্লা (প্রধান শিক্ষক, লাখপুর হাইস্কুল), আজিম উদ্দিন আহমেদ (শিক্ষক, পরে এডভোকেট), আবদুর রহমান মাস্টার (শিক্ষক, মরজাল হাইস্কুল), আবদুস সালাম (প্রধান শিক্ষক, নারায়ণপুর হাই স্কুল), মতিউর রহমান (বেলাব), প্রমুখকে নিয়ে নিজ এলাকায় ভাষা-আন্দোলন পরিচালনা করেন। তাছাড়া বাংলাভাষা বিরোধী পুস্তিকার প্রতিবাদ স্বরূপ ‘বায়ান্নর পান্ডুলিপি; বাংলা বনাম ঊর্দূ রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক’ নামে একটি বই লিখেন। উক্ত বইয়ে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণে ছাত্রদের মৃত্যুর খবর নরসিংদীতে পৌছলে নরসিংদীবাসী গর্জে ওঠে। আন্দোলনের নেতৃত্বে দিতে এগিয়ে আসেন আবুল হালিম, আফসার উদ্দিন, মুসলেহ উদ্দিন ভুইয়া, রমিজ উদ্দিন, করিম মিয়া, কফিল উদ্দিন ভুইয়া, সামাদ মৌলভী ও চাঁন মিয়া। ২১ ফেব্রুয়ারির পর ঢাকার সকল কর্মসূচির প্রতি একাত্ম প্রকাশ করে নরসিংদীতে সকাল হতে রাস্তাঘাট, রেলপথ এবং নরসিংদীর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পুলিশ কর্তৃক ছাত্র-জনতাকে বাঁধা প্রদান না করায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দোকানপাট বন্ধ ছিল এবং দুপুরের পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শরু হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীতেও মিছিল হয়েছে জব্বার, রফিক, বরকতদের প্রাণ হরণের প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন তিনি নিজে, মওলানা ভাসানী এবং দলের অন্যতম যুগ্মসম্পাদক রফিকুর ইসলাম। ২৩ ফেব্রæয়ারির জনসভার প্রচার চলাকালীন ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক উত্তাল অবস্থায় তারা ধারণা করেন ২৩ তারিখের সভা সম্ভব হবে না। মওলানা ভাসানী এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেই পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক নরসিংদীতে জনসভা করতে রাজী হলে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে প্রথম শ্রেণির টিকেট কেটে নরসিংদী নিয়ে যান। রীতিমতো ভন্ডুল একটি জনসভা এই পরিস্থিতিতে সর্বপ্রধান জাতীয় নেতার উপস্থিতিতে সার্থক করার আনন্দ মোসলেহ উদ্দিন ভুইয়ার বুকে খুব করে বেজেছিল। পরে জানা গেছে মওলানা ভাসানীকে তেজগাঁও স্টেশনেই গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু যথাসময়ে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। মওলানা ভাসানী পূর্ব নির্ধারিত জনসভা করার জন্য নরসিংদী রওনা হয়ে গেছেন জানতে পেরে নির্ধারিত বক্তা রফিকুল ইসলামও নরসিংদী এসে উপস্থিত হন। শামসুল হক এর মধ্যেই গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় আসতে পারেননি।
২৩ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঐতিহাসিক গান্ধীর ঈদগাহ ময়দানে বিরাট জনসভায় রফিকুল ইসলাম ও মওলানা ভাসানী বক্তৃতা করেন। এই সভার সভাপতি ছিলেন নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আফসার উদ্দিন সরকার। সভায় তেজোদীপ্ত কণ্ঠে মওলানা ভাষানী বলেন, মুসলিম লীগ সরকারের পতনের জন্য সকল ট্যাক্স বন্ধ করে দিত হবে। গুলিবর্ষণের তদন্ত ও বিচার করতে হবে। বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। নাজিমউদ্দিন সরকারকে পদ থেকে টেনে নামাতে হবে।
ভাসানীকে গ্রেফতারের জন্য ইতোমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশ নরসিংদী পৌছে গেছে। তারা এক মিষ্টির দোকানের আড়ালে, আশপাশের চা দোকনে একজন ডিএসপির নেতৃত্বে ছদ্মবেশে অবস্থান করছিল। সভাশেষে মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মোছলেহ্ উদ্দিন ভুঁইয়ার বাড়িতে রাতে খাবার খান। পরে ফরিদ উদ্দিন ও চাঁন মিয়ার সহযোগিতায় হ্যাজাক লাইট জ¦ালিয়ে ভাসানীকে ষ্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। স্টেশনে পুলিশের অবস্থান বুঝতে পেরে তারা মওলানা ভাসানীকে হাজীপুর গ্রামে এক নিরাপদ আস্তানায় নিয়ে যান। একদিন পর নৌকা যোগে নারায়ণগঞ্জ হয়ে তিনি ঢাকা পৌছান।
নরসিংদীর ভাষা-আন্দোলনের নেতা এবং কর্মীদের এই আলোচনা সভাটি ছিল ঐতিহাসিক। অন্যান্য থানা হতে কেউ সাইকেলে এমনকি পায়ে হেঁটে নরসিংদী শহরে এসে আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন। বিকেলের এই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (ক) রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে আন্দোলনের ডাক দিবে তাতে আমরা সাড়া দেব (খ) ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সরকার যে ঘটনা ঘটিয়ে পূর্ববাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে তা বানচাল করতে হবে। এরপর সন্ধ্যার পূর্বে সারা শহর মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে। নরসিংদীতে পুলিশের নির্যাতন ও ধরপাকড়া শুরু হয়। ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে পুলিশ নরসিংদীর নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার শুরু করেন। এ সময় প্রবীন রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম মিয়া, আবুল ফজল মিয়া, সুরেশ পোদ্দার ও সৌরদানন্দ লেন্টুকে পুলিশ গ্রেফতার করে। মোছলেহ্ উদ্দিন ভুইয়া গ্রেফতার এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কারারুদ্ধ ভাষাকর্মী আজমল হোসেনের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের কামরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠক হয়। এই বৈঠকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘটের ঘোষণা করা হয়। সরকারের দমননীতির কারণে ঢাকার কোনো প্রেস থেকে নগদ টাকায়ও হরতাল সংক্রান্ত ইশতেহার ছাপাতে রাজী না হওয়ায় যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. সুলতান ও কাজী আজিজুর রহমান নরসিংদী থেকে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে আনেন এবং তা ঢাকা শহরে বিলি করা হয়।
ঘোড়াশাল হাইস্কুলের ছাত্রবৃন্দ ২৩ তারিখে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে এক সভায় কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। একটি প্রস্তাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে শহীদদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সহানুভ‚তি জানিয়েছে এবং নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করেছে।
২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আদিয়াবাদ ইসলামিয়া হাইস্কুলের ছাত্রদের এক সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে নিরস্ত্র জনসাধারণ ও ছাত্রদের উপর পুলিশের বেপরোয়া গুলি চালনার তীব্র্র প্রতিবাদ করা হয় । অপর একটি প্রস্তাব শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে অপরাধী কর্মচারীদের শাস্তি ও নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করে সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা তৈরি করেন প্রথম শহিদ মিনার। ভাষাশহিদ বরকত যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সেই মেডিকেল ব্যারাকের ১৩ নং কক্ষের সামনেই স্থাপতি হয়েছিল শহিদ স্মৃতি স্তম্ভ। শহিদ স্মৃতি স্তম্ভ অর্থাৎ প্রথম শহিদ মিনার। আজ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই মহান স্থাপত্যকীর্তিটি নির্মাণের সাথে জড়িত ছিলেন তৎকালীন মেডিকেল কলেজের ছাত্র নরসিংদীর ডা. ফজলুল করিম পাঠান। তিনি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে নরসিংদী সদরসহ থানা পর্যায়ে। ঢাকায় নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য ২৮ ফেব্রæয়ারি মনোহরদী থানার হাতিরদিয়া বাজারে এক জনসভা হয়। সভায় প্রায় ১৫ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ডা. মোজাফফর হোসেন। ঐদিন হাতিরদিয়া, মনোহরদী, শিবপুর ও শিমুলিয়ায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সভায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ, গুলিবষর্ণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত, দায়ি ব্যক্তিদের প্রকাশ্য বিচার, নিহতদের অভিভাবকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি পালিত হয়। স্থানীয় স্কুল-কলেজ, দোকানপাট বন্ধ থাকে। বেলা ১১ টায় ছাত্রদের এক মাইল লম্বা শোভাযাত্রা বের হয়। এদিন বিকেলে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পুলিশের গুলিবর্ষণের নিরপেক্ষ তদন্ত ও ভাষা-আন্দোলন সম্পার্কিত বন্দিদের মুক্তি দাবি করা হয়। এই ঐতিহাসিক সভাটির খবর তৎকালীন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। ৪ মার্চ, ১৯৫২ তারিখে প্রকাশিত আজাদ পত্রিকার রিপোর্টটি ছিল এ রকম:
‘হাতিরদিয়া, ২৮ শে ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় পুলিশের গুলীবর্ষণে নিহতদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য মনোহরদী থানার অন্তর্গত হাতিরদিয়ার বাজারে এক বিরাট সভা হয়। ডা. মোজাফফর হোসেন সভাপতিত্ব করেন। সবায় প্রায় ১৫ হাজার লোক উপস্থিত হইয়াছিলেন। এইদিন হাতিরদিয়া, মনোহরদী, শিমুলিয়ার পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। সভায় ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলীবষর্ণের তীব্র নিন্দা করা হয়। বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ, গুলীবষর্ণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা এবং দায়ী বলিয়া সাব্যস্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য বিচার, নিহতদের অভিভাবকগণকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের দাবি এবং আরবী হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ জানাইয়া সভায় কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়।’
২৯ ফেব্রæয়ারি, ১৯৫২ তারিখে নরসিংদীর শিমুলিয়ায় এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২৬ ও ২৭ তারিখ শিমুলিয়া বাজারে হরতাল পালিত হয়।
২৮ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি শিবপুর হাইস্কুলের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করেন। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘আরবি হরফে বাংলা চলবে না’ ছাত্রবন্দিদের মুক্তি চাই’ ইত্যাদি স্লোগানসহ এক মিছিল বের হয়। বেলা ৪টায় ধানুয়া ঈদগাহ ময়দানে মৌলভী মোহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে এক জনসভা হয়। এ সভা আনুমানিক রাত ১০ টা পর্যন্ত চলে। সভায় ৪/৫ হাজার লোক সমাগত হয়।
পলাশ থানার পলাশ বাজরে পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে এক সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন হাজী নওয়াব আলী। এই সভায় ৩/৪ হাজার লোক সমবেত হয়। ঢাকায় গুলীবর্ষণের ফলে নিহত ছাত্রদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকল্পে ৫ মার্চ রায়পুরায় শান্তিপূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। রায়পুরা স্কুলের ছাত্রদের উদ্যোগে এখানে এক সভা হয়। সভায় কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয়। আবদুর রহমান মাস্টার সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রাভাষার মর্যাদা দান, বিনা শর্তে রাজবন্দিদের মুক্তি, গুলীবর্ষণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন ও দোষী ব্যক্তিদের বিচার এবং নিহতদের ক্ষতিপুরণ দাবির করে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
“নরসিংদী ৫ই মার্চ। অদ্য নরসিংদীতে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। স্থানীয় স্কুল কলেজ, দোকানপাট সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। বেলা ১১ টায় ছাত্রদের এক মাইল লম্বা এক শোভাযাত্রা বাহির হয়। অপরাহ্নে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ঢাকায় পুলিশের গুলীবর্ষণ সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আটক বন্দীদের মুক্তি দাবী করা হয়।”
১৯৫২ সালে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র নরসিংদীর পলাশের ছেলে মো.নবীউল হক রিকাবদার ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঐতিহাসিক সমাবেশ ও মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। একুশের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের আরেক প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন তৎকালীন স্কুল ছাত্র (পরে প্রিন্সিপাল) আবদুস শহীদ। তার বাড়ি মনোহরদী থানার বীর আহম্মদপুর গ্রামে। ঢাকা থেকে ফিরে একুশের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মনোহরদী থানায় আন্দোলন ও প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন তিনি। ২৫ ফেব্রæয়ারি সাদত আলী ইংরেজি স্কুলের সকল ছাত্ররা তারই নেতৃত্বে কালো ব্যাজ ধারণ করে এবং বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করে। হাতিরদিয়া স্কুলের নূরুল ইসলাম মোল্লা হাতিরদিয়া স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করেন এবং লাগাতার স্কুল বর্জনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন।
নরসিংদী সদর উপজেলার বাহারুল উলুম মো.দেওয়ান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে গান লিখে নিজেই সুর করে সভা-সমিতিতে পরিবেশ করতেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আরেক সাহসী সৈনিক ছিলেন নরসিংদীর গর্বিত সন্তান আবদুল করিম পাঠান। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন। থাকতেন ফজলুল হক মুসলিম হলে। সাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভাষাসৈনিক জিল্লুর রহমান, প্রয়াত ভাষা সৈনিক গাজীউল হক ছিলেন তার রুমমেট। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি পর্বে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই স্মরণীয়। ঢাকায় ও স্থানীয়ভাবে নরসিংদীর আরো যারা ভাষা-আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি পর্বে ভূমিকা রাখেন তারা হলেন, রিয়াজ উদ্দিন মোল্লা (সৈয়দের গাঁও), নূরুল ইসলাম মোল্লা (চর মনোহরদী), ইনামুল হক (কুচের চর), আশরাফ হোসেন খান (সৈয়দের গাঁও), ফিরোজ আল মুজাহিদ (রায়পুরা), মো.কমর উদ্দিন সরকার (মনোহরদী), মো. আবু তাহের ভূঁইয়া (রায়পুরা), মহিউদ্দিন আহমদ (রায়পুরা), মোহাম্মদ আলী (রায়পুরা) প্রমুখ।
নরসিংদীর গর্বিত সন্তানদের মধ্যে যারা ঢাকার রাজপথে আন্দোলন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লেখক,কবি, ভাষা সংগ্রামী ড.আলাউদ্দিন আল আজাদ। তিনি নরসিংদীর রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামের কৃতী সন্তান। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দুটি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্মদাতা তিনি।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রহত্যার পর আলাউদ্দিন আল আজাদের উদ্যোগেই একুশের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছিল। বুলেটিনটির শিরোনাম ছিল “বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর কবর রচনা করব।’ উক্ত শিরোনামটি লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। এটাই ছিল একুশের প্রথম বুলেটিন। তাছাড়া প্রথম শহীদ মিনার নিয়ে তিনিই প্রথম কবিতা রচনা করেছিলেন। সেই ঐতিহাসিক কবিতা, “স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চার কোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো”।
এ কবিতা শুধু কবিতা নয়, শোকগাথা নয়, এ কবিতাটি ছিল সার্বজনীন মানুষের সংগ্রামী চেতনার প্রতীক। ভাষাসংগ্রামী মুখলেছুর রহমান নরসিংদীর আরেক সূর্য সন্তান যার গৌরবদীপ্ত অবদান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তার পৈত্রিক নিবাস নরসিংদীর সদর থানার চিনিশপুর গ্রামে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ তারই প্রস্তাবক্রমে ঐ কমিাটির আহবায়ক নির্বাচিত হন আবদুল মতিন।
নরসিংদীর শিবপুরের সন্তান একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসংগ্রামী মোহাম্মদ মাশির হোসেনের উদ্যোগে সর্বপ্রথম আবদুল গাফফার চৌধুরীর “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি আবদুল লতিফের কণ্ঠে গাওয়া হয়েছিল। এ সময় তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের ভিপি। এ কারণে তিনি কলেজ থেকে বহিস্কৃত হন। নরসিংদীর জেলার মনোহরদী থানার অধ্যাপক হাবিবা খাতুন একুশের হত্যাকান্ডের পর ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজপথের মিছিলে অংশগ্রহণ করেন, এবং প্রথম কোনো স্কুলে শহিদ মিনার নির্মাণে অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি সরকারি কামরুন্নেছা স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। এই স্কুলের ছাত্রীরাই প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণ করেছিলেন এবং এটাই ছিল কোনো স্কুলে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার।
নরসিংদীতে প্রথম শহিদ মিনার নির্মিত হয় ১৯৫৪ সালের শেষের দিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র জনতার সর্বাত্মক অংশগ্রহণের কারণে সে সময় শহিদ মিনার নির্মাণে তেমন একটি বাধা আসেনি। শহিদ মিনার নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত অস্থায়ী শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো। অস্থায়ী শহিদ মিনারে নির্মাণ করা হয় স্থানীয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। নরসিংদীতে ১৯৫৪ সালে প্রথম শহীদ মিনারটি এখন নরসিংদী মহিলা কলেজের চত্বরে অবস্থিত।
স্বাধীনতা লাভের পর শহিদ মিনার পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালে সেই সময়কার শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী নরসিংদী সরকারি কলেজের শহিদ মিনারটিকেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করে এটিকেই শহরের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার হিসেবে ঘোষণা করেন। ঐতিহ্যবাহী নরসিংদী সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণের শহিদ মিনারকে এতদিন ছাত্র-শিক্ষক ও প্রশাসনের সর্বস্তরের লোকজন নরসিংদীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার হিসেবে জেনে আসলেও বিগত এক বছরের ব্যবধানে জেলা প্রশাসক ও পৌর মেয়র শহরে আরো দুটি শহিদ মিনার নির্মাণ করেছেন। একুশের মহান শহিদের স্মরণে বর্তমানে নরসিংদী জেলার প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে নরসিংদীর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভ‚মিকা। একুশের চেতনা বাস্তবায়নে বাংলা ভাষার বিকাশে নরসিংদীর কৃতী সন্তানদের অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। ভাষাবিদ ও ভাষা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ বাংলা ভাষার একনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে আজ শুধু নরসিংদী নয় উপমহাদেশেরও গর্ব। গ্রন্থবিজ্ঞানী ও লেখক মনোহরদীর মোহাম্মদ সা’দত আলী উপমহাদেশ তথা বাংলা ভাষাভাষীদের ইতিহাসে প্রথম বাংলাভাষায় গ্রন্থ বিজ্ঞানের বই রচনা করে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এমআর মাহবুব ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক যিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর সবচেয়ে বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। বাংলাভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য নরসিংদীর শাহাদাৎ হোসেন মন্টু ঘটিয়েছিলেন আরেক বিপ্লব। তিনি পাকিস্তানের মাটিতে বসে একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবসে ছাত্র-ছাত্রীদের কালো ব্যাজ পরিয়েছিলেন। মিছিল করেছেন এবং শহিদ দিবস উদযাপন করেছেন। তিনি তখন পাকিস্তানের লাহোরে অধ্যয়নরত এবং East Pakistan Student Association’ এর সভাপতি ছিলেন। এই ঘটনা তখন পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং পত্রপত্রিকা ও জনমনে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে নরসিংদীর আরেক কৃতী সন্তান সাবির আহমেদ চৌধুরীর পাকিস্তানের মাটিতে সর্বপ্রথম পাকিস্তানী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের এক সভায় বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির ইন্টার কন্টিন্যান্টাল হোটেলে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে নির্মাতা ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করেন। উক্ত অনুষ্ঠানের কার্যবিবরণীতে শুধু উর্দু এবং ইংরেজি ভাষাতে বক্তৃতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু সাবির আহমেদ চৌধুরী বাংলা ভাষাকে যুক্ত করার দাবি উত্থাপন করেন। উক্ত সভায় তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বাংলা ভাষায় বক্তব্য রেখেছিলেন। উক্ত ঐতিহাসিক ঘটনাটি ছিল ভাষা-আন্দোলনের সফলতার পর্বের এক বিরাট বিজয়।
লেখক : গবেষক ও চেয়ারম্যান, নরসিংদী প্রেসিডেন্সি কলেজ, ব্রাহ্মন্দী, নরসিংদী। ০১৭১৭৩২৪৯৭৫