নিজস্ব প্রতিবেদক
নরসিংদীতে ক্রেতা সমাগমের মধ্য দিয়ে জমজমাট হয়ে উঠেছে ঈদ বাজার। তীব্র গরম উপেক্ষা করে বিপণিবিতান ও শপিংমলগুলোতে ভিড় করছেন ক্রেতারা। ঈদের বাকী আর মাত্র কয়েকদিন। শেষ মূহুর্তে এসে নরসিংদী জেলা, মধাবদী শহরসহ উপজেলা সদরগুলোর বিভিন্ন বিপনী বিতান গুলোতে ক্রেতাদের উপচে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। আর ঈদ বাজারকে কেন্দ্র করে শহরের রাস্তা ঘাট গুলোতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে নরসিংদী জেলা শহরসহ মাধবদী ও উপজেলা সদরগুলোর বিভিন্ন বিপণিবিতান, শপিংমলগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় ততই বাড়ছে। ইতোমধ্যে ঈদ কেনাকাটা জমে উঠেছে। দুই বছর করোনার কারণে কঠিন সময় পার করে ভালো বিক্রির আশা ব্যবসায়ীদের।
নরসিংদীর ঈদবাজারে এবার দেশি কাপড়ের চাহিদা বেশি। এরই মধ্যে শহরের মার্কেট ও বিপণি বিতানগুলোতে চলছে গভীর রাত পর্যন্ত ঈদের কেনাকাটা। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষ সাধ্যমতো ঈদের কেনাকাটা করছেন। বড় বড় বিপণিবিতানের পাশাপাশি ফুটপাতের দোকানগুলোতেও কেনাকাটায় মানুষের ঢল নেমেছে। ফুটপাতের দোকানগুলোতে সাধারণত রিকশা চালক, দিনমজুরসহ সাধারণ মানুষের ভিড় বেশি।
শহরের সিএ বি রোডের সিটি সেন্টার, নয়ন তারা প্লাজা, কাজী সুপার মার্কেট, সদর রোডের ইন্ডেক্স প্লাজা, সুলতান শপিং কমপ্লেক্স, স্টেশন রোডের নিয়াজ মার্কেটসহ আশপাশে অন্যান্য মার্কেট গুলো এবং নরসিংদী বাজারের পুরাতন পোস্ট অফিস রোড, কালীবাড়ী রোডের বিভিন্ন বিপণী বিতানগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে প্রচন্ড গরমকে উপেক্ষা করে কেনাকাটায় ব্যস্ত ক্রেতারা। এবার ঈদ মার্কেটে এসেছে হরেক রকম বাহারী ডিজাইনের রঙ-বেরঙের পোশাক।
বিক্রেতারা জানান, এবছর বিদেশি পোশাকের চেয়ে দেশি পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের ঝোঁক বেশি। তরুণীদের পছন্দের কিছু ভারতীয় ও পাকিস্তানী পোশাক বিক্রি হওয়ার বাইরে বিদেশি পোশাকের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ নেই ক্রেতাদের। গত শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শহরের বিভিন্ন শপিং সেন্টার ঘুরে দেখা গেছে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। তরুণ-তরুণীরা ব্যস্ত হাল-ফ্যাশনের পোশাক ক্রয়ের জন্য।
তরুণ তরুণীদের পছন্দের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে সিটি সেন্টার, নয়ন তারা প্লাজা, কাজী সুপার মার্কেট, ইসলাম প্লাজা, ইন্ডেক্স প্লাজা, সুলতান শপিং কমপ্লেক্স, কালীবাড়ী রোডের বিভিন্ন বিপণী বিতানগুলে। এসব মার্কেট ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে বিক্রির শীর্ষে রয়েছে মেয়েদের থ্রি-পিস।
নয়নতারা প্লাজা ও কাজী সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, একেকটি দোকান সাজাতে কোটি টাকার বেশি পোশাক দোকানে তুলতে হয়েছে। সিএ বি রোড, সদর রোড ও সুলতান শপিং কমপ্লেক্সের বড় নামি-দামি শো-রুমগুলোতে বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে পোশাক তোলা হয়েছে ঈদকে কেন্দ্র করে। তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান।
রুচিশীল ক্রেতারা তাদের ছেলে মেয়েদের একটু দামি পোশাক কেনার জন্য ভিড় করছেন দর্জিবাড়ী, রেসি ফ্যাশন, ইজি ফ্যাশন, কটন ফ্যাশন, লোটো, কাকতারুয়া, ম্যানস্ জোন, রং, মার্ক্স-3, গ্রামীন মেলা, ভ্ঁইয়া ফ্যাশনসহ শহরের বিভিন্ন নামি-দামি শো-রুমগুলোতে। এ সব শো-রুমগুলোতে ছেলেদের জন্য এবার এসেছে বিভিন্ন ডিজাইনের পাঞ্জাবি। নগরীর বিপণী বিতানসহ শিশুদের পোশাকের দোকানগুলোতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। ক্রেতাদের ভিড়ে দোকানের কর্মচারীদের কথা বলার কোনো ফুসরত নেই।
তরুণ তরুণীদের কেনাকাটার পাশাপাশি বেশিরভাগ নব-বিবাহিত নারীরা ভিড় করছেন শাড়ির দোকানে। এখানকার শাড়ির বাজার দীর্ঘদিন একচেটিয়া দখল করে রেখেছেন সুলতান শপিং কমপ্লেক্স ও সিএন্ডবি রোডের কয়েকটি নামি-দামি শাড়ি কাপড়ের শো-রুমগুলো।এবারের ঈদ মার্কেটে কাতান শাড়ি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে, জামদানি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে, সিল্কের শাড়ি ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা, বালুচরী পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়াও সুলভ মূল্যে শাড়ি ও যাকাতের কাপড় বিক্রি করছেন নরসিংদী বাজারের জিন্নাহ পার্কের আশপাশের কাপড়ের দোকান গুলো।
তবে শেষ মূহুর্তে এসে কাপড়ের দোকান গুলোর চেয়ে জুতার শো-রুমগুলোতে বেশী ভিড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। কালীবাড়ী রোডের শতরূপা, রেডটপ ছাড়াও অন্যান্য নামী-দামী শো-রুম গুলোতে দীর্ঘ লাইন দিয়ে ভিতরে ঢুকতে দেখা গেছে। দোকানীদেরও দম ফালানোর ফুসরত নেই।
একটি সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তা আব্দুল হাই বলেন, মূলত ঈদে পোশাক কেনাকাটার আনন্দই আলাদা।
শহরের বাজির মোড়ের সুন্দুরী বস্ত্রালয়ের মালিক রিপন সাহা বলেন, ‘গত দুই বছর ঈদের সময় লকডাউন আর বিধিনিষেধে কেটেছে। এবার করোনা নিয়ন্ত্রণে আছে। আশা করি, ভালো কেনাবেচা হবে। এ বছর ঈদে সিল্ক আর জামদানি শাড়ির চাহিদা বেশি। তাছাড়া সিল্ক, বেনারসি, কাঞ্জিবরণ, জামদানি, কারচুপি, কাতান, ঝুট জামদানি, মাচরাইচ ও কটনসহ নিভিন্ন ধরনের শাড়িও ভালো বিক্রি হচ্ছে।’
সিএন্ডবি রোডের দোকানী কামরুল হোসেন জানান, ‘এই বছর বিভিন্ন ডিজাইনের পাঞ্জাবির মধ্যে রয়েছে ইন্ডিয়ান ব্রাশু, গুটি ও টিস্যু। তবে বেশি চলছে কবলি। পাশাপাশি গেঞ্জি, শার্ট-প্যান্টও কিনছেন অনেকে।’
রেসি ফ্যাশনের ম্যানেজার জানান, ‘প্রতি বছর ঈদে ভারতীয় সিরিয়ালের নামে পোশাক চান ক্রেতারা। তবে এ বছর তেমন পোশাকের চাহিদা নেই। ছোট মেয়েদের নতুন দুটি পোশাক এসেছে সরারা ও গারারা। তবে বেশি চলছে স্কার্ট ও ফ্রক।’এছাড়া তরুণরা ভাইরাল হওয়া ‘কাঁচাবাদাম’ ও ‘পুষ্পা’সহ বিভিন্ন চরিত্রের আদলের পাঞ্জাবি ক্রয় করছেন।
যদিও একাধিক দোকান মালিক জানান, কোনও চরিত্রের আদলে কোনও পোশাক না হলেও ক্রেতার চাহিদার কথা মাথায় রেখেই সাধারণ পাঞ্জাবি ও থ্রি-পিসে ভাইরাল নাম দিয়ে বিক্রি করা হয়।
শরিফ ম্যানশনের একটি শাড়ির দোকানের মালিক বলেন, গত দুই ঈদে দোকান খুলতে পারিনি। তবে এবার আশাবাদী, ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবো। যে কারণে বেশি বিক্রি ও সময় বাঁচাতে বেশি দাম চাই না। অল্প লাভে যেন বেশি পণ্য বিক্রি করতে পারি।
ইজি ফ্যাশনে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা স্কুলশিক্ষক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, প্রচণ্ড গরমের কারণে দিনে কেনাকাটা করা কঠিন। তাই আমরা রাতে কেনাকাটা করতে এসেছি। রাতে কোনও দোকানই ফাঁকা থাকে না, তবুও দেখে শুনে ঠাণ্ডা মাথায় শপিং শেষ করতে পারি।
এসময় ইজি ফ্যাশনের ম্যানেজার বলেন, দিনে ভিড় বেশি হলেও কেনাকাটা খুব বেশি হয় না। সেই তুলনায় রাতে বিক্রি ভালো। রাতে যারা আসেন তাদের বেশিরভাগই পছন্দের পোশাক কিনেই বাড়ি ফেরেন।
ইন্ডেক্স প্লাজার একটি কসমেটিক্স হাউজের মালিক বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে আধুনিক সব প্রসাধনী দোকানে তুলেছি। ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সকালের পাশাপাশি সন্ধ্যার পর ব্যাপক ক্রেতা সাড়া মিলছে।’
সাঈদ হোসেন নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘দুপুরে এসেছি কেনাকাটা করতে ফিরতে সন্ধ্যা হবে। বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাই, বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য কেনাকাটা করছি।’
এদিকে নরসিংদী বাজার সিএন্ডবি রোডের ফুটপাতের অস্থায়ী দোকানগুলোতেও বেচাকেনা জমে উঠেছে। সিএন্ডবি রোড এলাকার ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, গত দুই বছর কিছু করতে পারিনি এবার একটু দাঁড়াবার চেষ্টা করছি। আল্লাহর রহমতে বেচাকেনা ভালাই চলছে।
এ ছাড়াও বিভিন্ন পাড়ায় গজিয়ে উঠা শপিং মল গুলোতে নতুন নতুন দোকানে পাওয়া যাচ্ছে অত্যাধুনিক গার্মেন্টস আইটেমের পোশাক।
নরসিংদীর বানিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত মাধবদী শহরের বিভিন্ন বিপনী বিতানগুলোতে নারী-পুরুষ ও শিশু কিশোরদের উপচে পড়া ভীড় লক্ষ্য করা গেছে। জেলার উপজেলা শহরগুলোতেও একই চিত্র দেখে গেছে।
এদিকে ঈদকে সামনে রেখে ব্যাপক ব্যস্ত সময় পার করছেন নগরীর টেইলার্সগুলোর দর্জিরা। সময়মত পোশাক ডেলিভারি দেওয়ার চিন্তায় তারা দিন-রাত সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে। দর্জিরা জানান, ২০ রমজানের পর আর কোনো নতুন অর্ডার নেওয়া হয়নি। ইতোমধ্যে যে অর্ডার তারা নিয়েছে তা সময় মত ডেলিভারি দিতেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) জানান, ‘ঈদকে ঘিরে নরসিংদীর শপিংমল, মার্কেট, বিপণিবিতানগুলোতে কেনাকাটার চাপ বেড়েছে। এ সময় অতিরিক্ত জনসমাগমের কারণে আইনশৃঙ্খলার কোনও অবনতি যেন না ঘটে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ মার্কেট, শপিংমল, সড়কের সম্মুখে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া সাদা পোশাকধারী ডিবি পুলিশের টিম মার্কেট গুলোর সামনে সাধারণ মানুষের বেশে অবস্থানরত আছেন। পাশাপাশি তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকছে মার্কেটজুড়ে। পিকেটিং, হোন্ডা স্পেশাল ও নিয়মিত মোবাইল টহল থাকছে।’ মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ঈদ কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতে পারে সেজন্য মার্কেটগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে।