নিজস্ব প্রতিবেদক
নরসিংদীর মেহেরপাড়ার জামিয়া কওমিয়া নামে একটি মহিলা মাদ্রাসায় মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে দুই ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) নরসিংদী সদর উপজেলার ‘কুড়েরপাড় জামিয়া কওমিয়া নামে ওই মহিলা মাদ্রাসার’ শৌচাগারের ভেতর থেকে মাইশা আক্তার (১০) নামের এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হলে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে এই দুটি মৃত্যুর বিষয়ে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এটিকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দিতে চাইলে ও নিহতের পরিবারের দাবি এটি আত্মহত্যা নয় বরং এটি একটি পরিকল্পিত ‘হত্যাকাণ্ড’।
এর আগে গত ১৯ অক্টোবর বিকেলে উক্ত মাদ্রাসার অপর একটি শৌচাগারের ভেতর থেকে আফরিন আক্তার (১৬) নামের আরেক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহত মাইশা আক্তার নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী থানাস্থ ভগীরথপুর এলাকার ডাইং শ্রমিক নেছার উদ্দিনের মেয়ে।
সে ওই মাদ্রাসায় আবাসিক ছাত্রী হিসেবে থেকে মক্তব ২য় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে আসছিল। অন্যদিকে বিগত দেড় মাস আগে এই মাদ্রাসার অন্য একটি শৌচাগার থেকে মাধবদীর দড়িগাজীরগাঁও এলাকার ডালিম মিয়ার কণ্যা অত্র মাদ্রাসাটির আলিম প্রথম বর্ষের (উচ্চমাধ্যমিক) শিক্ষার্থী আফরিন আক্তারের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
দেড় মাসের ব্যবধানে একই মাদ্রাসার শৌচাগার থেকে দুইজন ছাত্রীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন উঠছে।
বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে চারটার দিকে উপজেলার শেখেরচরের কুড়েরপাড়ের জামিয়া কওমিয়া মহিলা মাদ্রাসার শৌচাগারের ভেন্টিলেটরের গ্রিলের সাথে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় মাইশা আক্তারকে উদ্ধার করা হয়।মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ দ্রুত তাকে নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিষয়টি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় পুরোপুরিভাবে গোপন রাখে।
শুক্রবার(২ডিসেম্বর) সকালে ওই ছাত্রীর লাশ নরসিংদী সদর হাসপাতাল মর্গে থাকা অবস্থায় লোকমুখে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদ্রাসাটিতে নরসিংদী জেলা ছাড়াও অন্যান্য জেলার মোট ৮৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। যার মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থী প্রায় সাড়ে ৪ শত জন।মোট ৮৫০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে পুরুষ শিক্ষক ৯ জন এবং নারী শিক্ষক আছেন ২২ জন। তাছাড়া দুজন পুরুষ ও দুজন নারী গার্ড রয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ এখানে থাকেন, আবার কেউ কেউ নির্ধারিত সময় দায়িত্বপালন করে চলে যান।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেলে আসরের নামাজ পড়া অবস্থায় মাদ্রাসার ভেতর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ পাওয়া যায়। ভয়ে ও আতঙ্কে ছাত্রীরা সব দৌড়াদৌড়ি করছিল। কয়েকজন শিক্ষক মিলে শৌচাগারের ভেতর থেকে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় দশ বছর বয়সী মাইশাকে ভেন্টিলেটরের রডের সাথে বাঁধা অবস্থা থেকে নামানো হয়।পরে তাকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মাইশার পরিবারের সদস্যরা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে মাঈশার বাবা নেছার উদ্দিন মাদ্রাসায় গিয়ে তাকে দুপুরের খাবার দিয়ে আসেন। তিনি সেখান থেকে ফিরে আসলে দুপুরে পরিবারের সবাই পলাশের ঘোড়াশালে এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যান। সেখানে থাকা অবস্থায়ই বিকেল সাড়ে চারটার দিকে নেছার উদ্দিনের মোবাইল ফোনে মাদ্রাসার একজন শিক্ষক তাকে হাসপাতালে আসতে বলেন।
নেছার উদ্দিন ‘নরসিংদীর খাসখবর’কে জানান বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমাকে ফোন করে মাদ্রাসার এক শিক্ষক বলেন, “মাইশাকে অসুস্থ অবস্থায় নরসিংদী সদর হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে, আপনি দ্রুত আসেন। আমি দ্রুত হাসপাতালে যাই কিন্তু আমার মেয়েটাকে জীবিত পাইনি।
এসময় আমি এবং হাসপাতালের নার্সরা তার কপাল ও গালসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাই। আমাদের ধারণা, তাকে আঘাত করে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রেখেছিল। পরিবারের অন্যদের সাথে আলোচনা করে মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
মাইশার মা অভিযোগ করে বলেন, ‘১০ বছরের একটি শিশু কীভাবে গলায় ফাঁস নিয়ে এভাবে ঝুলে আত্মহত্যা করতে পারে? আমার মেয়েকে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে তারা। মেয়ের সারা শরীরে মাইরের চিহ্নই এর প্রমাণ,অবশ্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
নরসিংদী সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল উদ্দিন খান বলেন, শিশুটিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তার গলায় ফাঁসের চিহ্ন ছাড়াও একাধিক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার সাথে ঠিক কী ঘটনা ঘটেছে, তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে বিস্তারিত জানানো যাবে।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি আহসানুল্লাহ বলেন, ‘ওই ছাত্রী নিজের ওড়নার সাহায্যে শৌচাগারের ভেন্টিলেটরের রডে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। এত অল্প বয়সী একটি শিশু কেন আত্মহত্যা করল, খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানতে পেরেছি, তাকে সাথে না নিয়ে তার মা–বাবাসহ পুরো পরিবার ঘোড়াশালে এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিল। এতে কষ্ট পেয়ে মাইশা আত্মহত্যা করে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে তাকে স্বাভাবিকই থাকতে দেখেছে সবাই। সকালে তার বাবা এসে হাতে খাবার দিয়ে গিয়েছিল, দুপুরে মৌখিক পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছে সে।’
পরপর দুই ছাত্রীর মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মুফতি আহসানুল্লাহ বলেন, ‘গত ১৯ অক্টোবর আত্মহত্যা করা আফরিন আক্তারের মৃত্যুর বিষয়ে তার পরিবার স্বীকার করেছে, সে মাদ্রাসায় আসতে না চাওয়ায় তার মা–বাবা inতাকে মারধর করে জোর করে তাকে মাদ্রাসায় দিয়ে গিয়েছিল। মাদ্রাসার ফটকের সামনেই তাদের কথোপকথনে আমরা বিষয়টি জেনেছিলাম। মেয়ে বলছিল, জোর করে মাদ্রাসায় দিয়ে গেলে আমি আত্মহত্যা করব। বাবা বলছিলেন, “মরলে এখানেই মর, লাশ এসে আমি নিয়ে যাব।” এরপরই ওই ছাত্রী মাদ্রাসার একটি শৌচাগারে গিয়ে নিজের ওড়না ভেন্টিলেটরে পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।’
মাধবদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রকীবুজ্জামান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেই খবর পেয়ে সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কে এম শহিদুল ইসলামসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনেছি। শুক্রবার দুপুরে নরসিংদী সদর হাসপাতাল মর্গে শিশুটির লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ও জানান তিনি।