নিজস্ব প্রতিবেদক
এশিয়ার সর্ববৃহৎ সার কারখানা ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) দুপুরে গণভবন থেকে নরসিংদীর ঘোড়াশাল-পলাশ ফার্টিলাইজার প্রকল্প এলাকায় ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তিনি।
একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)-এর বহুতল ভবন ও মাদারীপুরে সম্প্রসারিত বিসিক শিল্প নগরী; বিটাকের টেস্টিং সুবিধাসহ টুল ইনস্টিটিউট এবং বিএসইসি-এর এলইডি লাইট (সিকেডি) এ্যাসেমব্লিং প্ল্যান্ট প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু প্রযুক্তি পরিবর্তনশীল, তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযুক্ত জনশক্তি যাতে গড়ে উঠে তার ব্যবস্থাও আমরা নিয়েছি। বাংলাদেশে শতভাগ বিদ্যুৎ দিয়েছি। আমাদের কথাই ছিল ২০২১ সাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও ২০২০ সাল জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছি। এই সময় আমাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর আমরা আলোকিত করব। আমরা আজকে শতভাগ বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম হয়েছি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, এটা ঠিক আমাদের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক। কিন্তু শিল্পায়নও আমাদের প্রয়োজন। এটি কর্মসংস্থান ও রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি করে। পাশাপাশি আমাদের দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণ আমাদের বার বার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে বলেই, আজকে বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছি।২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ১৫ হাজার ৫৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ৪৫ হাজার ৩৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে ২০২টি দেশ বা অঞ্চলে ৭৬৬টি পণ্য রপ্তানি করতে পারছি।
কৃষিপণ্য খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে সরকারের গুরুত্ব দেওয়ার কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, খাদ্য উৎপাদনে আমরা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছি। গবেষণার মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন ক্ষেত্রে খাদ্য, ফলমূল, তরিতরকারি, মাছ, ডিম, মাংস উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছি। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করতে পারলে আমরা যেমন বিদেশে রপ্তানি করতে সক্ষম হব, পাশাপাশি আমাদের নিজের দেশের মানুষেরও যেহেতু ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে, সেখানেও বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশব্যাপী পরিবেশবান্ধব শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছি। আমাদের পরিবেশ রক্ষা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে। তাই আমরা প্রতিটি শিল্প, কল-কারখানা থেকে শুরু করে যত প্রতিষ্ঠান তৈরি করছি, সেটা পরিবেশবান্ধব যেন হয়, তার ব্যবস্থা নিচ্ছি। পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রতি লক্ষ্য রেখেই পদক্ষেপ নিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি, সেই সময় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের সামনে আরও অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সেটা পালন করতে হবে।
এ সময় ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক সহায়তা দেওয়ায় চীন ও জাপানকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, নতুন এই সার কারখানায় দৈনিক ২৮০০ মেট্রিক টন ও বার্ষিক প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদন হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে ১০ শতাংশ ইউরিয়া উৎপাদন বাড়ানো হবে।
সরকার প্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পোন্নয়নে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, ফলে বর্তমানে শিল্প নগরীতে (বিসিক) বিনিয়োগের পরিমাণ ৪১ হাজার ২শ ১৭ কোটি টাকা এবং ৮ লাখের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) দক্ষমানব সম্পদ উন্নয়ন এবং গবেষণার মাধ্যমে আমদানি বিকল্প যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিটাকের টুল অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট (টিটিআই) দেশের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। আমাদের সরকার লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে নতুন উদ্যোক্তা তৈরিসহ এ সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য স্থানীয়ভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। টেস্টিং সুবিধাসহ বিটাকের টুল ইনস্টিটিউট দেশীয় প্রযুক্তিতে বিভিন্ন মেশিন এবং প্লান্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়ক হবে। তাতে ভবিষ্যতে মূলধনী যন্ত্র আমদানিতে বিনিয়োগ কমবে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। জাতির পিতা এই দেশ স্বাধীন করেছেন। একদিকে যেমন দারিদ্র বিমোচন করা, দেশের মানুষের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নতি করা এবং বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গড়ে তোলা। সেজন্য আমরা আমাদের লক্ষ্য স্থির করেছি। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গড়ে উঠবে। ডেল্টা প্ল্যান আমরা প্রণয়ন করেছি। ফলে জলবায়ু অভিঘাত থেকে রক্ষা পাবে বাংলাদেশ। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন উন্নত জীবন পায়, তা নিশ্চিত করবে।
শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করেছে। খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করেছে। তবে বাংলাদেশে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ, প্রণোদনা ও নগদ অর্থ সহায়তার মাধ্যমে আমরা আমাদের অর্থনীতির গতিকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। তাই করোনার সময়েও আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনটাকেও ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।
নরসিংদীর পলাশে প্রান্ত থেকে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা।
এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি, স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. আনোয়ার আশরাফ খান, শিবপুরের সাংসদ জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন, বিসিআইসির চেয়ারম্যান শাহ মো. ইমদাদুল হক, প্রজেক্ট ডিরেক্টর রাজিউর রহমান মল্লিক, জেলা প্রশাসন-পুলিশ প্রশাসনসহ প্রকল্পে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও সুধিজনেরা উপস্থিত ছিলেন।
১০ হাজার ৪৬০.৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি চালু হলে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন ও বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সার উৎপাদন সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কাজ শুরু হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন পর আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো। ইতোমধ্যেই এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই সার কারখানা প্রকল্পের ৭০ ভাগের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে।