সব
facebook raytahost.com
আন্দোলনের উত্তাপে যে জুলাই মাস ‘হয়ে উঠেছিল ৩৬ দিনের | Holypennews

আন্দোলনের উত্তাপে যে জুলাই মাস ‘হয়ে উঠেছিল ৩৬ দিনের

আন্দোলনের উত্তাপে যে জুলাই মাস ‘হয়ে উঠেছিল ৩৬ দিনের

মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু

জুলাই মাস সাধারণত ৩১ দিনের হলেো ২০২৪ সালের এই মাসটি ক্যালেন্ডারের পাতাকে ছাপিয়ে আন্দোলনের উত্তাপে তা হয়ে যায় ৩৬ দিনের দীর্ঘ এক সংগ্রামের নাম। ‘৩৬ দিনের এই জুলাই’ শুধু একটি প্রতীকী মাস বা তারিখই নয়— এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য নতুন অধ্যায়। রক্তাক্ত সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ‘৩৬ দিনের জুলাই’ হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের মুহূর্ত।

২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টের পালাবদলের শুরুটা হয়েছিল ৫ জুন, যখন হাইকোর্ট এক রায়ে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। রায়ের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তারা একে ‘বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য’ হিসেবে উল্লেখ করে সোচ্চার হতে থাকেন। ওইদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম প্রতিবাদ মিছিল বের হয়, যা পরদিন আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করে। প্রতিবাদের এই স্ফুলিঙ্গ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই থেমে থাকেনি। ক্রমেই তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

এর মধ্যেই ঈদের ছুটির কারণে আন্দোলনে সাময়িক বিরতি আসে। তবে ১ জুলাই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দিন থেকেই আন্দোলন ফিরে আসে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে। শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন, যা দ্রুতই জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। নেতৃত্বহীন কাঠামো এবং সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই আন্দোলন হয়ে ওঠে নতুন ধারার গণসংগ্রাম।

এ অবস্থায়ই ৪ জুলাই, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। পরদিন থেকে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচি। ৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘোষণা আসে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির, যা ৭ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। এই কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে সড়ক ও রেলপথে অবরোধ তৈরি হয়, অচল হয়ে পড়ে জনজীবন।

পরবর্তীতে ১০ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে। কিন্তু তাতেও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। বরং শুরু হয় সহিংসতা, যা পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। ১৪ জুলাই শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। এই দিনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে আখ্যা দেন। তিনি গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন— ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-নাতি-পুতিরা কেউ মেধাবী না, যত রাজাকারের বাচ্চারা মেধাবী?’ এই বক্তব্য শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন করে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গাত্মক স্লোগান তোলে—‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার/কে বলেছে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার/হয়ে গেলাম রাজাকার।’

এ অবস্থায় আন্দোলনের টুটি চেপে ধরতে মাঠে নামে ছাত্রলীগ। বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর চালানো হয় হামলা। ১৫ জুলাই ঢাবিতে ছাত্রলীগের হামলায় বহু শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর ঢামেকে আহতদের ওপর আবারও হামলা হয়। একই রাতে জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের আরেকটি হামলা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। রংপুরে সংঘর্ষে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তাকে গুলি করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর পরপরই জনতার ক্ষোভ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ওই রাতেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার, কিন্তু তাতে আন্দোলন থামেনি। বরং শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বের করে দেন, ঘোষণা করেন ‘রাজনীতিমুক্ত’ ক্যাম্পাস।

১৭ ও ১৮ জুলাই আন্দোলনে যুক্ত হন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। ঢাকা শহর তখন রূপ নেয় এক যুদ্ধক্ষেত্রে। সেদিন দেশ জুড়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির আওতায় আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে, যার ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২৯ জন নিহত হন। সরকার প্রধান ২০ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব দিলেও আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ।

জুলাইয়ে আন্দোলনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছিল ১৯ জুলাই । রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। হাসপাতালগুলোতে লাশের স্তূপ জমতে থাকে, শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। মেট্রোরেল স্টেশন, এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, নরসিংদীর জেলখানা—সবখানেই সহিংসতা ও প্রতিরোধের চিত্র দেখা যায়। শেষমেশ জারি হয় কারফিউ,রাস্তায় নেমে আসে সেনাবাহিনী ।

১৯ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকা তিন সমন্বয়ক—আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদ—এর খোঁজ পাওয়া যায় ২৪ জুলাই।
২৫ জুলাই আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে আট দফা বার্তা দেওয়া হয়, যার মধ্যে ছিল—হতাহতদের তালিকা তৈরি, হামলাকারীদের চিহ্নিতকরণ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দিতে চাপ সৃষ্টি, ২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ তিন সমন্বয়ককে সাদা পোশাকধারীরা রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায়। ২৭ জুলাই গোয়েন্দা পুলিশ আরও দুই সমন্বয়ক—সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহকে হেফাজতে নেয়। ২৮ জুলাই রাতে পুলিশ হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তবে আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ দাবি করে, ‘এই ঘোষণা পুলিশি হেফাজতে, চাপে, এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে দেওয়া হয়েছে।’ তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।

৩১ জুলাই ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির মাধ্যমে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদ জানানো হয়। ১ আগস্ট ডিবি হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ককে মুক্তি দেওয়া হয়। ২ আগস্ট ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। একই দিন মুক্তিপ্রাপ্ত সমন্বয়কেরা এক বিবৃতিতে জানান, ‘পুলিশি দপ্তর থেকে প্রচারিত আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বিবৃতি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়নি।’

৩ আগস্ট শহীদ মিনারের সমাবেশে ঘোষণা আসে—সরকার পতনের এক দফা। ৪ আগস্ট ঘোষিত হয় ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি, যা একদিন এগিয়ে এনে নির্ধারণ করা হয় ৫ আগস্টে এবং সেই দিন—৫ আগস্ট; যা ইতিহাসে লেখা হয় ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে, ছিল দীর্ঘতম প্রতিবাদের বিজয় দিন। লাখো মানুষ ঢাকায় সমবেত হয়, পথে নামে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে। সেদিন দুপুরের আগেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। শেষ হয় একটি অধ্যায়ের, সূচনা হয় নতুন একটি সময়ের— তারুণ্যের, সাহসের, সমতার ও পরিবর্তনের সময়।

এত কিছুর পরও আন্দোলন থেমে থাকেনি। বরংস্ফুলিঙ্কের মত তা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এটিকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়। প্রতিবাদের এই ঢেউ থেমে থাকেনি ৩১ জুলাইয়ে। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে তা এগিয়ে গেছে আরও একদিন। শহীদ, প্রতিবাদ, প্রতিশোধ— সবকিছু মিলিয়ে এক মাস পরিণত হয় এক ঐতিহাসিক ৩৬ দিনে। কারণ জনগণ জানিয়ে দেয়—জুলাই তখনও শেষ হয়নি, যতক্ষণ না বিজয় আসে।

জুলাই আন্দোলন শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি একটি প্রজন্মের জাগরণ। যে প্রজন্ম দীর্ঘদিন রাজনীতি ঘৃণা করে বেড়ে উঠেছিল, তারা বুঝে যায়— রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে বাঁচা যায় না, বরং রাজনীতিকে বদলে দিয়েই বাঁচতে হয়। এই উপলব্ধি থেকেই তারা হয়ে ওঠে বিপ্লবী, আর সেই বিপ্লবের নাম—৩৬ দিনের এক জুলাই।

আপনার মতামত লিখুন :

যৌতুক নিয়েও থামেনি নির্যাতন, করলেন দ্বিতীয় বিয়ে; ন্যায়বিচার প্রার্থণায় আদালতে নির্যাতিতা স্ত্রী

যৌতুক নিয়েও থামেনি নির্যাতন, করলেন দ্বিতীয় বিয়ে; ন্যায়বিচার প্রার্থণায় আদালতে নির্যাতিতা স্ত্রী

স্বামীর দেওয়া আগুনে দগ্ধ স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যু

স্বামীর দেওয়া আগুনে দগ্ধ স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যু

‘নেই পত্রিকা নেই কোন অনলাইন ফেসবুকে লিখেই তিনি সাংবাদিক; মনোহরদীর অভিশাপ শাকিল’

‘নেই পত্রিকা নেই কোন অনলাইন ফেসবুকে লিখেই তিনি সাংবাদিক; মনোহরদীর অভিশাপ শাকিল’

আগামীকাল নরসিংদীতে তারুণ্যের প্রাণের উৎসব “নৌকা বাইচ ”

আগামীকাল নরসিংদীতে তারুণ্যের প্রাণের উৎসব “নৌকা বাইচ ”

ইভিএম পদ্ধতি বাতিল পুনর্বহাল হচ্ছে ‘না ভোট’

ইভিএম পদ্ধতি বাতিল পুনর্বহাল হচ্ছে ‘না ভোট’

রায়পুরা কলেজ শাখা ছাত্রদলের  কমিটি নিয়ে বিএনপি নেতা শ্যামলকে অবাঞ্চিত ঘোষণা

রায়পুরা কলেজ শাখা ছাত্রদলের  কমিটি নিয়ে বিএনপি নেতা শ্যামলকে অবাঞ্চিত ঘোষণা

সর্বশেষ সংবাদ সর্বাধিক পঠিত
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ সারোয়ার খান

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৮৮, তরোয়া, নরসিংদী
ফোনঃ 01711205176 ই-মেইল : mdsaroarkhan@gmail.com
©২০২১ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। Design & Developed By: Khan IT Host .com